পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে কাইয়ুম সরকার পড়ালেখা বেশি করতে পারেননি। অল্প বয়সেই সংসারের ভার আসে কাঁধে। ছোট্ট কাইয়ুম বাবার সঙ্গে কৃষি কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে স্বপ্ন গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায় একের পর এক বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার চেষ্টা করেন। অজ্ঞাত কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু ইচ্ছা যখন বড় হওয়ার, তখন বাঁধা দেওয়ার সাধ্য কার!অবশেষে সফলতার পালক যুক্ত হয় তার ঝুলিতে। তাকে দেখে আশেপাশের মানুষও বেশ উদ্ধুদ্ধ হচ্ছেন। তিনি এখন অন্যদের অনুপ্রেরণা।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের পৈলানপুর গ্রামের বাসিন্দা কাইয়ুমের (৫০) কাছে বয়স যেন একটি সংখ্যা মাত্র। এই বয়সে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে চলছেন। তার পরিশ্রম স্বপ্ন পূরণের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তার কর্মদক্ষতা অনেক দূর আসতে সহায়তা করেছে।
কাইয়ুম সরকার জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করেছেন। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করেছেন। কিন্তু সবসময়ই চাইতেন ব্যতিক্রম কিছু করার। সেই লক্ষ্যে প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে বিভিন্ন সফল মানুষের গল্প দেখতেন। আর ভাবছেন তিনি তাদের মতো কিভাবে সফল হতে পারেন। এমনি করে একদিন ইউটিউবের একটি চ্যানেলে দেখতে পান বরই (কুল) চাষে সফলদের গল্প। আর এই বিষয়টি তাকে খুবই উদ্ধুদ্ধ করে।
পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেন তিনিও বরই (কুল) চাষ করবেন। ইউটিউব ভিডিওতে দেওয়া মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেন দেশের বিভিন্ন এলাকার বরই (কুল) চাষিদের সাথে। নিজের প্রয়োজনে তিনি কয়েকটি জেলায় বরই (কুল) চাষিদের সাথে দেখা করতে চলে যান। তাদের সাথে কয়েকদিন ঘুরে ফিরে আসেন বাড়ি। আর সিদ্ধান্ত নেন তিনিও বরই (কুল) চাষ করবেন।
সিদ্ধান্ত স্থির করার পর বরই (কুল) চাষে তার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় জমি। নিজের পর্যাপ্ত জমি না থাকায় অন্যের কাছ থেকে ৪ বিঘা জমি ১০ বছরের জন্য লিজ নেন। ২ বিঘা জমিতে পেঁয়ারা, লেবু ও টমেটু চাষ করেন। আর বাকি ২ বিঘা জমিতে তিনি শুরু করেন বরই (কুল) চাষ। মেহেরপুর ও ফরিদপুরের বরই (কুল) চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন অস্ট্রেলিয়ান বলসুন্দরী জাতের চারা গাছ। প্রথম অবস্থায় সাড়ে ৪০০ চারা নিয়ে আসেন তিনি। ২ বিঘা জমিতে সেই চারা লাগিয়ে পরিচর্যা করতে থাকেন।
বিভিন্ন সময় স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে পরামর্শ নেন। কৃষি অফিসও তাকে নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। প্রায় ৯ মাস পরে আসে কাইয়ুমের সফলতা। প্রতিটি গাছে প্রায় ২০/২৫ কেজি করে বরই (কুল) ধরে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আশেপাশের জেলার বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করেন। পাশাপাশি তিনি এখন এই জাতের চারা উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, তার উৎপাদিত চারা গাছে স্থানীয় বেকার যুবকরা বরই (কুল) চাষ করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারবেন।
পৈলানপুর গ্রামের যুবক কাজী ফয়সাল (১৯) বলেন, অনেকদিন ধরেই শুনছি এই এলাকাতে বরইয়ের (কুল) চাষ হচ্ছে। ফলনও নাকি খুব ভালো হয়েছে। যে গাছগুলোতে ফল ধরেছে, সেই গাছগুলো নাকি অনেক ছোট। তাই আগ্রহ থেকে দেখতে চলে আসলাম। তবে আসার পর আমি অবাক হয়েছি। বরই (কুল) গাছ অনেক ছোট, কিন্তু বরইয়ের (কুল) ভারে গাছের ডাল মাটিতে নুয়ে পড়েছে। বরইগুলোও (কুল) হয়েছে বেশ বড় বড়। এর আগে এমন গাছ দেখিনি। তা ছাড়া, বরইগুলোও (কুল) খেতে খুব সুস্বাদু।
একই গ্রামের বাসিন্দা বজলুর রহমান (৫৭) বলেন, কাইয়ুম ছোটবেলা থেকে খুবই কর্মঠ ছিলেন। চাষাবাদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করতেন। যতদূর জানি, তিনি ইউটিউব দেখে বরইয়ের বাগান করেছেন। আমার বাড়ির খুব কাছে, তাই এই বাগানের পাশ দিয়ে আমাকে যাতায়াত করতে হয়। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ আসে তার বাগান দেখতে। বরইর (কুল) জাত ও ফলন ভালো হওয়ায় আশা করা যায় তিনি বেশ লাভবান হবেন।
পার্শ্ববর্তী বক্তারপুর গ্রামের আরেক যুবক নূর হোসেন মেরাজ (২১) জানান, অনেকের মুখে শুনে তিনিও এসেছেন বরই (কুল) বাগান দেখতে। এসে নিজের হাতে গাছ থেকে বরই (কুল) ছিঁড়ে খেয়েছেন। পাশাপাশি আগামী বছর নিজের জায়গায় এমন বাগান করবেন বলে ১০০ চারা গাছ কেনার পক্রিয়া করছেন। তবে অন্য কাজের পাশাপাশি বরই (কুল) বাগান করলে তাতে তিনিও লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবীদ ফারজানা তাসলিম বলেন, কাইয়ুম একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরামর্শের জন্য কৃষি অফিসে এসেছেন। উপজেলা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই তার বরই (কুল) বাগান পরিদর্শন করেছেন। তিনি প্রয়োজন মনে করলে স্থানীয় কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।